আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি

আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি কি?
বর্তমান শিক্ষাদান পদ্ধতি হাতে-কলমে উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে করতে হয়। বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে শিক্ষক নিজেই উপকরণ তৈরি করে শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা করবেন। শিক্ষকতা হলো এক ধরনের সৃষ্টিধর্মী প্রক্রিয়া, শিক্ষকতা কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়।

আধুনিক শিক্ষণ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর নিজস্ব প্রয়োজন, সামর্থ্য, আগ্রহ, পছন্দ-অপছন্দের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও শিক্ষা পদ্ধতির আমূল সংস্কারের প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই শিক্ষণ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীর স্বাধীনতার স্বীকৃতি, শিখনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ, তার পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ, সুশৃঙ্খল মানব শক্তির অধিকারী করে তোলা, সৃজনশীলতার উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং ব্যক্তিসত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ। সুতরাং শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় শিক্ষা পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এখানে আলোচনা করা হলো-

১) বক্তৃতা পদ্ধতি (Lecture Method): বক্তৃতা পদ্ধতি একটি একমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীরা শোনে। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করার বা শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ থাকে না। বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষক মৌখিক বিবৃতির সাহায্যে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর কাছে উপস্থাপন করেন। এতে শিক্ষকের বাগ্মিতা, বক্তৃতাদানের কলাকৌশল, বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীর হৃদয়গ্রাহী করে তোলার ক্ষমতা, শিক্ষার্থীর বয়স, মেধা, আগ্রহ ইত্যাদি বিবেচনা করে শিক্ষণীয় বিষয়কে আর্কষণীয়ভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতার উপর শিক্ষাদানের সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

২) প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি (Question Answer Method): প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষক প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থী উত্তর দেয়। এ পদ্ধতিতে আলোচনার কোন সুযোগ নেই, শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষককে প্রশ্ন করার কোন অবকাশ নেই। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষক ছোট, ছোট প্রশ্নের মাধ্যমে পাঠের বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করেন। শিক্ষার্থীরা সে সকল প্রশ্নের উত্তর দান করে পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে তৎপর হয়।

৩) প্রদর্শন পদ্ধতি (Demonstration Method): প্রদর্শন পদ্ধতিও একটি একমুখী প্রক্রিয়া। বক্তৃতা পদ্ধতির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, শিক্ষার্থীর দুটি ইন্দ্রিয় এতে সক্রিয় থাকে। শিক্ষার্থী শোনে এবং দেখে। শ্রেণী পাঠদানে কোন বাস্তব ঘটনার বা বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া প্রদর্শন পদ্ধতি নামে অভিহিত। বক্তৃতাদান পদ্ধতিতে শিক্ষক কেবল মৌখিক বিবৃতির মাধ্যমে কোন বিষয়বস্ত শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করেন।

৪) টিউটোরিয়াল পদ্ধতি (Tutorial Method): টিউটোরিয়াল একটি সুপ্রাচীন পদ্ধতি। গ্রীক মনীষী সক্রেটিস এই পদ্ধতির প্রর্বতক বলে একে সক্রেটিকে পদ্ধতি নামেও অভিহিত করা হয়। এতে শিক্ষক জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো চিহৃিত করে তা প্রশ্নকারে উপস্থাপন করেন। শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে তাদের চিন্তা ও যুক্তির অবতারণা করে। এভাবে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার উত্তর প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রকৃষ্ট উপায় নিদের্শ করা হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানো হয়। শিক্ষক সাহায্যকারী ও পরামর্শ দাতার ভূমিকা পালন করেন।

৫) পূর্ব নির্ধারিত পাঠ (Assignment): এই পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষক নিজে পাঠ্য বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বেই শিক্ষার্থীদের নিজেদের পাঠ্য বিষয়টি অনুশীলনের মাধ্যমে অনুধাবন করার নির্দেশ দান করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে চিন্তা ভাবনাও মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পায়। শিক্ষক পাঠ্য বিষয়ে সহায়ক গ্রন্থ সম্পৃক্ত নির্দেশ দান করেন। শিক্ষক/শিক্ষিকার নির্দেশ মতো শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয়টি পড়ে ও বুঝে নিজেরাই তার মর্ম গ্রহণে তৎপর হয়।

৬) আলোচনা পদ্ধতি (Discussion Method): এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে কোন একটি সমস্যার সমাধান বের করার জন্য পারস্পরিক আলোচনালিপ্ত হয়। তারা সমস্যাটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মত বিনিময় করে তথ্য সংগ্রহ করে। সমস্যার স্বরূপ ও পরিধি সমন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করার পর দায়ী কারণ গুলো সনাক্ত করে। সবদিক বিবেচনার পর তারা সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে নেয়। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি বসে স্বাধীনভাবে আলোচনা করলেও সমস্ত আলোচনা শিক্ষক/শিক্ষিকা বা দলনেতা কর্তৃক পরিচালিত হয়।

৭) প্যানেল আলোচনা পদ্ধতি (Panel): প্যানেল কথাটি বলতে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য মনোনীত এক দল লোককে বুঝায়। এই পদ্ধতি সাধারণ আলোচনা পদ্ধতিরই একটি বিশিষ্ট্য রূপ। এই ধরনের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে কয়েক জনকে আগে থেকে মনোনয়ন দান করা হয়। সেই প্যানেল ভুক্ত শিক্ষার্থীরা নিদিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করে।

৮) সেমিনার (Seminar): সাধারণ অর্থে সেমিনার বলতে আলোচনা ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ক্লাসকে বোঝানো হয়। এই পদ্ধতি সাধারণত বয়স্ক ও উচ্চতর শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যই অধিক উপযোগী। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ও সমস্যামূলক কোন বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উচ্চ শ্রেণীতেও সেমিনার পদ্ধতি অনুসরণ করা যেত পারে।

৯) সিম্পোজিয়া (Symposium): সিম্পোজিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ সুনির্দিষ্ট ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কোন বিষয়ে বিভিন্ন মতের সংগ্রহ করা। এটিও এক প্রকার দলগত আলোচনা। তবে পরিচালনার দিক থেকে এর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সিম্পোজিয়া পদ্ধতিতে দুই বা ততোধিক শিক্ষার্থী আলোচ্য বিষয় বা সমস্যার ওপর আগেই প্রবন্ধ রচনা করে নিয়ে আসে। তারা প্রথমে তাদের লিখিত প্রবন্ধ কিংবা মৌখিক বিবৃতি পেশ করে। বিভিন্ন বক্তা বিষয়টির উপর নতুন তথ্য পরিবেশন করে। এই ভাবে কয়েকটি বক্তৃতার মাধ্যমে বিষয়গুলো আলোচিত ও বিশ্লেষণ করা হয়। নির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তার পূর্ব প্রস্তুতি থাকে বলে আলোচনাটি সুসংহিত রূপ লাভ করে। বিভিন্ন বক্তা সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *